ভয়েস অব পটিয়াঃ মোদি বিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশকে কেন্দ্র করে ত্রিমুখী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন অন্তত ৪ জন
মোদী বিরোধী বিক্ষোভ, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে নিহত ৪, প্রতিবাদে হরতালের ডাক |
ভয়েস অব পটিয়া-ন্যাশনাল ডেস্কঃ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ আগমনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী মোদি বিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশে সাধারণ মুসল্লীসহ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সাথে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মী ও পুলিশের ত্রিমুখী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন অন্তত ৪ জন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ২ দিনব্যাপী সফরকে কেন্দ্র করে গতকাল থেকে উত্তাল ছিল সারাদেশ।
ভারতে মুসলিম গণহত্যার প্রতিবাদের আজ শুক্রবার জুমার নামাযের পর ঢাকায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে আয়োজিত এক বিক্ষোভ সমাবেশকে কেন্দ্র করে সাধারণ জনগণ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, জুমার নামাজের মোনাজাত শেষে মুসল্লি জনতার একাংশ মোদিবিরোধী বিক্ষোভ শুরু করলে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরা মসজিদের উত্তরপাশ হতে লাঠিসোটা নিয়ে তাদের উপর হামলা চালায়। আত্মরক্ষার্থে মুসল্লি জনতা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মসজিদ লক্ষ্য করে টিয়ারশেল-গুলি ছুঁড়ে পুলিশ। এ সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অন্তত ৭০ জন।
এদিকে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে মোদিবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল বের করলে পুলিশের সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন। আহতদের উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চিকিৎসার জন্য নেওয়ার পর ৪ জন মারা যান। নিহতদের মধ্যে ৩ জন দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র বলে জানা যায়, অপরজনের সাধারণ নাগরিক বলে জানা যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সাধারণ মুসল্লি ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে হাটহাজারী থানার দিকে এগুতে চাইলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ারশেল-রাবার বুলেট ছুঁড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে সংঘর্ষ আরও বাড়লে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। এতে গুলিবিদ্ধ হয় অন্তত ৮ জন। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করালে তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ৪ জন মারা যায়। (২৬-০৩-২০২১)
পুলিশের দাবি, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমনের প্রতিবাদে হেফাজতের ইসলামের অনুসারীরা মিছিল করার চেষ্টা করে। পুলিশ বাধা দিলে তারা হাটহাজারী থানায় প্রবেশ করে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। সংঘর্ষ চলাকালে রাস্তায় পুলিশ অবস্থান নিলে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে আগত অনুসারীরা অবস্থান নিয়ে ইটপাটকেল ছুঁড়ে। এ সময় আগুন দেওয়া হয় হাটহাজারী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়িতেও। ভাংচুর চালানো হয় ডাকবাংলো ও ভূমি অফিসেও। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুলি ছুঁড়ে পুলিশ।’
যদিও বিক্ষোভরত সাধারণ মুসল্লিদের দাবি, ‘তারা বিক্ষোভ মিছিল বের করলে পুলিশ এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা করে, এ সময় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি করা শুরু করে। এ সময় ৮ জন গুলিবিদ্ধ হয়।’
হেফাজতে ইসলামের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিসের দাবি, ‘পুলিশের গুলিতে সাধারণ মুসল্লিসহ কমপক্ষে ৭ জন ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়েছে।’
এদিকে ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোটসহ সমমনা ইসলামী দলগুলোর নেতৃবৃন্দরা এ ঘটনার প্রতিবাদে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আধিপত্যবাদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদিকে খুশী করার জন্য দেশের জনগণের বুকে গুলি চালিয়েছে সরকার। আজকে মুসল্লী ও দেশপ্রেমিক তৌহিদি জনতার উপর এই হামলা ও হত্যার দায় সরকারকে বহন করতে হবে। দেশবাসী এ হামলার সমুচিত জবাব দিবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিন মোদির জন্য দেশের জনগণের উপর এই হামলার ঘটনা এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। নেতৃবৃন্দ বিক্ষুদ্ধ জনতার ওপর বর্বরোচিত হামলার সাথে জড়িত পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারদের অবিলম্বে গ্রেফতার পূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সুচিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ দেয়ার জোর দাবি জানান।’
এ ঘটনার প্রতিবাদে শনিবার বিক্ষোভ ও রবিবার দেশব্যাপী হরতালের ডাক দিয়েছে হেফাজতে ইসলামের নেতারা। শুক্রবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও যুব অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি-সংঘর্ষ ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে সাধারণ বিক্ষোভকারীসহ আহত হন পুলিশের কয়েকজন সদস্যও।
এদিকে সারাদেশের ন্যায় পটিয়া উপজেলাতে মোদি বিরোধী বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয় (ভিডিও):
উল্লেখ্য, ২০০২ সালের ভারতে রাষ্ট্রীয় মদদে সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর গণহত্যা চালানো হয়। যা ‘গুজরাট দাঙ্গা’ বলে পরিচিত। ওই সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরএসএস-শিবসেনা-বিজেপির সমর্থকদের মদদ দিয়ে সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর সাম্প্রদায়িক বর্বর এই গণহত্যায় নীরব ভূমিকা পালন করায় তাকে ‘গুজরাটের কসাই’ও বলা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি এবং শ্রীলঙ্কার সমস্ত মহিলা আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক তথ্য-প্রমাণ কমিটি জানায়, "সন্ত্রাসের কৌশল হিসাবে এই রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলাদের উপরে যৌন সহিংসতা চালানো হয়। কমপক্ষে আড়াই শতাধিক বালিকা ও মহিলাদের গণধর্ষণ করা হয়েছিল এবং পরে তাদের পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। বাচ্চাদের জোর করে পেট্রোল খাওয়ানো হয় এবং তারপরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, গর্ভবতী মহিলাদের আগুনে পুড়ানো হয়েছিল এবং তারপরে তাদের পেটে অনাগত সন্তানের পোড়া দেহ দেখা যাচ্ছিল। নানদা পটিয়া গণকবরে ৯৬ টি দেহের মৃতদেহ ছিল, যার মধ্যে ৪৬ টি জন মহিলা ছিলেন। মৌলবাদী উগ্র হিন্দুরা তাদের বাড়ি প্লাবিত করে এবং ঘরের পুরো পরিবারকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে। মহিলাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার মধ্যে তাদের উলঙ্গ করে ছিনিয়ে নেওয়া বস্তুর মত ব্যবহার করেছিল এবং হত্যা করেছিল।
কল্পনা কন্নবিরানের মতে, উগ্র মৌলবাদী হিন্দুদের দ্বারা ধর্ষণগুলি একটি সুসংহত, ইচ্ছাকৃত এবং পূর্বপরিকল্পিত কৌশলের একটি অংশ ছিল এবং এই ঘটনাগুলি সহিংসতাকে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং গণহত্যার অংশ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। মহিলাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার অন্যান্য ক্রিয়াকলাপগুলির মধ্যে ছিল অ্যাসিড আক্রমণ, মারধর এবং গর্ভবতী মহিলাদের হত্যা। বাচ্চাদের তাদের পিতামাতার সামনে হত্যা করা হয়। জর্জ ফার্নান্দিস সহিংসতা নিয়ে সংসদে আলোচনায় রাজ্য সরকারের প্রতিরক্ষার পক্ষে ব্যাপক হট্টগোল সৃষ্টি করে বলেছিলেন যে ভারতে শুধুমাত্র এই প্রথমবারের মতো মহিলাদের আক্রমণ ও ধর্ষণ করা হয়নি। এ গণহত্যা-দাঙ্গায় ভারতে ১,০৪৪ জন নিহত, ২২৩ নিখোঁজ এবং ২,৫০০ আহত হয়। নিহতদের মধ্যে ৭৯০ জন মুসলমান এবং ২৫৪ জন হিন্দু ছিলেন। বহু নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের পাশাপাশি ব্যাপক লুটপাট ও সম্পদ ধ্বংসের খবর পাওয়া যায়। গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এবং পরবর্তীকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে এই সহিংসতা শুরু করার এবং প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়, যেমন পুলিশ এবং সরকারী আধিকারিকরা যারা দাঙ্গাকারীদের নির্দেশনা দিয়েছিল এবং মুসলমানদের মালিকানাধীন সম্পত্তির তালিকা তাদেরকে দিয়েছিল।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালে ভারতে শুরু হওয়া বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধন আইন-এনআরসি’কে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় মদদে দিল্লীতে গণহত্যার সূত্রপাত হয়। বিজেপি সমর্থকরা একে গুজরাট মডেলকে ফলো করে দাঙ্গায় রূপ দেয়। পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করে। কিন্তু তিন দিন ধরা জ্বলা আগুন আর নৃশংসতায় দিল্লির উত্তর-পূর্বের খাজুরি খাস এলাকায় ৪০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, শত শত মানুষ আহত এবং অনেকে নিখোঁজ হন। কোটি কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ নষ্ট করা হয়। প্রমাণ মিলেছে, পরিকল্পিতভাবে মুসলিমদের টার্গেট করা হয়েছিল এই দাঙ্গায়। নথিবদ্ধ প্রমাণাদি বলছে যে, সেখানে কিছু পুলিশ দাঙ্গাকারীদের সহায়তা করছিল বা বিষয়টিকে পুরোপুরি এড়িয়ে গেছে। খাজুরি খাস এলাকায় প্রায় ২০০টির মতো বাড়ি ও দোকান ছিল, যার এক পঞ্চমাংশের মালিক ছিল মুসলমানেরা। যারা জানেন না, তাদের পক্ষে দেখে বোঝা কঠিন ছিলো, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা ছোট ঘরগুলোর কোনটি মুসলমানের আর কোনটি তাদের হিন্দু প্রতিবেশীর। কোথাও কোথাও দুই ধর্মের দুই প্রতিবেশীর বাড়ির ছিলো একই দেয়াল। কোথাও কোথাও জোড়া লাগানো টানা ছাদ। তারপরও খুব সহজেই শুধুমাত্র মুসলিমদের বাড়ি আর দোকানগুলোতেই হামলা করেছিল দুষ্কৃতিকারীরা।
(স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম অবলম্বনে)
জানাতে পারেন আপনার মন্তব্য :
0 comments so far,add yours
~ মন্তব্য নীতিমালা ~
😀 আমাদের প্ল্যাটফর্মে মন্তব্য, আলোচনা, সমালোচনা বজায় রাখার জন্য আমরা একটি নীতিমালা তৈরি করেছি। আমরা আশা করি যে, কোন মন্তব্য পোস্ট করার সময় আপনারা তার অনুসরণ করবেন।
• ভয়েস অব পটিয়া কর্তৃপক্ষ ভিজিটর কর্তৃক নির্দেশিকা লঙ্ঘন করে এমন মন্তব্যগুলো মুছে ফেলার অধিকার সংরক্ষণ করে।
• জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স, লিঙ্গ, চেহারা বা অক্ষমতার ভিত্তিতে কোনো ব্যক্তি, কোন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রতি আপত্তিকর বা আক্রমণ করে এমন ভাষায় মন্তব্য করা যাবে না।
• আলোচনার বিষয়ের সাথে সম্পর্ক নেই এমন কোন মন্তব্য করা যাবে না। কিছু বিষয় ব্যতিক্রমী হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে, তবে আলোচনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে পারে এমন কোনো বিষয় ভয়েস অব পটিয়া কর্তৃক অনুমোদন করা হবে না।
• কোনো পক্ষকে আইনি ঝামেলায় ফেলতে পারে এমন মন্তব্য করা যাবে না।
• বাণিজ্যিক প্রকৃতির কিংবা বিজ্ঞাপনীয় উপাদান/লিঙ্ক রয়েছে এমন মন্তব্য করা যাবে না।
• যেসব মন্তব্য স্প্যামিং বলে মনে হচ্ছে এবং একাধিক পোস্ট জুড়ে অভিন্ন মন্তব্য করলে সেগুলো মুছে ফেলা হবে।
• ঘৃণাত্মক, সহিংসতার প্ররোচনা দেয় অথবা ধর্মকে আক্রমণ করে এমন কোন মন্তব্য করা যাবে না।